মাস্টারদা সূর্যসেন: এক অমরবিপ্লবীর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা

Editor

প্রকাশিত: ৪:৪৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০২৩
মাস্টারদা সূর্যসেন: এক অমরবিপ্লবীর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা
লেখক: রানা মাসুদ
ঘরে যদি থাকে শত্রু বন্ধু হয়েও শেষ রক্ষা হয়না। যেমনটা হয়েছিল মাস্টারদা সূর্যসেনের বেলায়। আত্মগোপনের সময় তাঁকে যখন গৈরালা গ্রামে ব্রজেন সেন নিয়ে আসলেন এবং ঐ গ্রামের বিশ্বাস বাড়ির গৃহবধূ ক্ষিরোদাপ্রভা ঘরে আশ্রয় নিলেন তখন সূর্যসেনের মাথার দাম দশ হাজার তৎকালীন টাকা। ব্রজেন সেনের ভাই নেত্র সেন দেখেন ব্রজেন সেন খাবার নিয়ে কোথায় যেন যায়। এই নেত্র সেনই মাস্টার দা সূর্যসেনের অবস্থানের কথা জানতে পেরে ব্রিটিশ পুলিশকে খবর দেয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। এরপর রাতের বেলা আলোর সংকেত দেখিয়ে নেত্র সেন ওয়ামসলীর নেতৃত্বে আসা একদল গুর্খা সৈন্যদের পথ দেখিয়ে আনে। বিষয়টি ব্রজেন সেন শেষ মুহূর্তে বুঝতে পারলেও সূর্যসেনকে রক্ষা করতে পারেননি।(১)
খুব অবাক হতে হয়, নিজের জীবন বাজি রেখে এক বাঙালি যখন লড়ছিলেন তখন আরেক বাঙালি তাঁকে ধরিয়ে দিল।
মাস্টারদা সূর্যসেন ফাঁসির কয়েক ঘণ্টা আগে লেখা তাঁর সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন-( মূল চিঠি ইংরেজিতে লেখা ছিল)
‘————– এগিয়ে চল,এগিয়ে চল
কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ——-
চট্টগ্রাম কারাগার বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
১১ জানুয়ারি, ১৯৩৪ বন্দেমাতরম,
সকাল ৭টা।'(২)
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি তাঁর ফাঁসি হয়।
আজ এই মহান বিদ্রোহীর প্রয়াণ দিবস।তাঁর সম্পর্কে আমরা কম বেশি সকলেই জানি। তবুও অল্প কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এঁর ডায়রি সূত্রে জানা যায়, সূর্যসেন বহুবার প্রাণে অথবা গ্রেফতার থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন যখন বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধে নিহত হয় তখন জ্বরে কাতর অপূর্ব সেন, নির্মল সেন এবং প্রীতিলতা একটি বাড়ির দোতলার ঘরে অবস্থান করছিলেন। সৈন্যদের আগমনের খবর সূর্যসেন জানতে পেরে প্রীতিলতাকে নিচের তলায় বাড়ির মহিলাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধের শুরুতেই ক্যামেরন নির্মল সেনের গুলিতে নিহত হয়। নির্মল সেনও এই আক্রমণের এক পর্যায়ে নিহত হন। প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে নিয়ে সূর্য সেন ঐ বাড়ি থেকে সরে যাবার সময় অপূর্ব সেন ব্রিটিশ বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। (৩)
হয়তো শ্যাম বর্ণ বলেই সূর্যসেনের ডাকনাম ছিল কালু। পুরো নাম সূর্য কুমার সেন। তিনি মাস্টারদা সূর্য সেন নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্ম এই মহান বিদ্রোহীর। বাবা ছিলেন রাজমনি সেন আর মায়ের নাম শশীবালা দেবী। চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তির আগে যখন নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ রোধ বা স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। তবে এই সময়ে বিপ্লবী আন্দোলনে তাঁর সম্পৃক্ততা নয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এ পড়ার সময় শিক্ষক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর মাধ্যমেই বিপ্লবী আন্দোলনে দীক্ষিত হন। অধ্যাপক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তী যুগান্তর নামের বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং তিনি চট্টগ্রাম ফিরে গিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী একটা বিপ্লবী দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। সূর্যসেন ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম ফিরে বিপ্লবী যুগান্তর দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
নিজেকে সন্দেহ থেকে দূরে রাখতে তথা একটা ছদ্মবেশের প্রয়োজনেই যেন ন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আর এই কারণে তথা শিক্ষকতার জন্য পরিচিত মহলে তিনি মাস্টারদা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন যা পরে তাঁর অন্যতম একটা আখ্যা হিসেবেই বহাল হয়।
মাস্টারদা সূর্য সেন এঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা সংগটিত হন। বিপ্লবের অর্থের প্রয়োজনে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের চট্টগ্রাম কোষাগার লুণ্ঠন করেন। এরপর জেল এবং ১৯২৮ – এ মুক্তির পর পুনরায় বিপ্লব ও বিপ্লবীদের সংঘটিত করতে শুরু করেন। তিনি ব্যামাগার প্রতিষ্ঠা ও শরীর চর্চার জন্য বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করেন। পরের বছর চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেস সম্মেলনে যোগাযোগ হয় সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে। সূর্য সেন নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিলের সশস্ত্র বিপ্লব ছিল সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার ফসল। গুড ফ্রাইডেতে অস্ত্রাগার লুট করতে পারলেও ভারী অস্ত্রের কোনো গুলি পায়নি বিপ্লীরা । কেউ কেউ বলেন এসময় বিদ্রোহীরা ভারি মেশিনগান পেলেও তার গুলি অন্যত্র থাকায় তা পায়নি। তবে সূর্য সেনের নেতৃত্বে পুলিশ অস্ত্রাগার দখলের পর অস্ত্র ও গুলি সংগৃহীত হয়। (৪)
নিখুঁত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পর অতর্কিত আক্রমণে বিপ্লবীরা দখল করেন শহরের দুটি অস্ত্রাগার এবং সেইসাথে শহরের সব প্রধান প্রধান সরকারি দফতর। বিপ্লবীরা বহির্জগতের সাথে চট্টগ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। যুগপৎ আক্রমণে চট্টগ্রাম শহর বিপ্লবীদের অধিকারে আসে। সূর্যসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা চট্টগ্রামকে তিনদিন স্বাধীন রাখেন। রাজনৈতিক ইতিহাসের আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই ঘটনা। স্বাধীন চট্টগ্রামের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়। বিপ্লবী লোকনাথ বলের নেতৃত্বে দলের সকলে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সর্বাধিনায়ক সূর্যসেনকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। মাস্টারদা সূর্যসেন ছিলেন ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির ‘ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি।(৫)
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে এক যুদ্ধে কিশোর বিপ্লবীসহ মোট ১৪ জন বিপ্লবী শহিদ হন।(৬ ) তবে অপর সূত্র মতে এই যুদ্ধে দুই কিশোরসহ ১১ জন বিপ্লবী শহিদ হন। জালালাবাদ পাহাড়ের এই যুদ্ধে ৬৪ জন ইংরেজ সেনা নিহত এবং ১০০ জন আহত হয়। (৭)
এরপর শুরু হয় চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম। যদিও প্রীতিলতা মাস্টারদা সূর্য সেনের নির্দেশে কল্পনা দত্তকে সঙ্গে নিয়ে ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রাম কারাগার উড়িয়ে দেবার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার ফলে ১১ জন বিপ্লবী গ্রেফতার হন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের এই ঘটনার পর ২৪ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলীর ইউরোপীয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ সম্পন্ন করলেও তিনি আহত হন। গুলিবিদ্ধ প্রীতিলতা গ্রেফতার এড়াতে তথা সঙ্গীদের যাতে কোনও তথ্য উদ্ধার করতে না পারে সে জন্য তিনি সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
গ্রেফতারের পর যুগান্তর দলের নতুন প্রধান তারকেশ্বর সূর্য সেনকে জেল থেকে ছিনিয়ে আনার প্রস্ততি নিলেও তা ব্যর্থ হয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের বিশেষ আদালতের বিচারের রায় ১৪ আগস্ট দেয়া হয় এবং এতে মাস্টারদা সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় দেয়া হয়। কল্পনা দত্তের দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। (৮) ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি রাত সাড়ে বারোটায় চট্টগ্রাম থেকে মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসির মঞ্চে হত্যা করে ইংরেজ শাসক। এরপর দুজনের মৃতদেহ গোপনে নিমজ্জিত করা হয় বঙ্গোপসাগরে(৯)।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯২৭ থেকে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ অবধি রংপুরের অধিকাংশ বিপ্লবী সংগঠনই যুগান্তরের সাথে যুক্ত ছিল। একমাত্র রংপুর শহরেই যুগান্তরের সভ্য সংখ্যা এক হাজারের বেশি ছিল। যে কোনো কারণেই হোক, চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা আগেই কাজে এগিয়ে যান। ফলে,রংপুরের প্রধান নেতারা যেমন: বাণী বাগচী, নলানী বাগচী, যতীন গুহ মণিকৃষ্ণ সেন প্রমুখ গ্রেফতার হয়ে যান। তা স্বত্বেও সংগঠনের অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহের কাজ ব্যাপক ভাবে চলতে থাকে।(১০)
একটু সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভিন্ন উপস্থাপন প্রসঙ্গে যাই। ছবিতে Chittagong নামের একটা চলচ্চিত্রের পোস্টার দেয়া হয়েছে। আলোচিত ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ভারতের বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজ বা বলিউড থেকে এই অসাধারণ ও পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে দ্বিতীয় বারের মতো ছবিটা দেখলাম। আলোচিত ঘটনার অনেকটাই ছবিতে উঠে এসেছে। আপনারা ছবিটি দেখতে পারেন। বিপ্লবীদের চট্টগ্রাম অধ্যায় উঠে এসেছে বহুলাংশে।
(লেখাটি পুনরায় পোস্ট করা হলো এই দিনটি স্মরণে )
তথ্যসূত্র:
১,২,৩ Quora : চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন:চারুবিকাশ দত্ত, কলকাতা, আমি সুভাষ বলছি।প্রথম খণ্ড। শৈলেন দে। বিশ্ববাণী প্রকাশ, কলকাতা।
৪) মোহাম্মদ শাহ, বাংলাপিডিয়া, ৫ মে, ২০১৪।
৫) কমরেড মণিকৃষ্ণ সেন-মোতাহার হোসেন সুফী,পৃষ্ঠা- ২৭
৬) মোহাম্মদ শাহ-পূর্বোক্ত।
৭) কমরেড মণিকৃষ্ণ সেন- পৃষ্ঠা- ২৮
৮) মোহাম্মদ শাহ-পূর্বোক্ত।
৯) মুক্তির সংগ্রামে ভারত পৃষ্ঠা ১২৭
১০) রংপুরের ইতিহাস-মোস্তফা তোফায়েল হোসেন, পৃষ্ঠা- ১৫৫( উদ্ধৃত গ্রন্থ: বিপ্লবী অবণী বাগচীর আত্মকথা।
(ছবি: লেখকের তোলা। লেখকের ছবি তুলেছেন হাসান মাহবুব আখতার লোটন। স্থান :বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন স্মৃতি ভবন, রাউজান, চট্টগ্রাম)